গল্প- অচেনা সেই মেয়েটি
লেখক -এম এম জিয়ন
পর্বঃ-০১
চোখভরা উপচে পড়া স্নেহ, মায়াভরা মুখ দেখেই প্রেমে পড়ে যায় রাফসান।কোনো রাস্তা, পার্ক, কোনো অনুষ্টান বা কেনো বিদ্যাপীঠে না,মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল এক পূর্ণিমা রাতে।কলেজ শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছিল রাফসান।কোনোদিনও ওর কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়নি,কিন্তু আজ অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। রাত বাজে ১২ টা।সবাই নিজের মতো যার যার বাড়ি চলে গিয়েছে, রাফসান বাদে।রাফসানের বাড়ি অনেকটাই দূরে।
কোনো গাড়ি না পেয়ে একা একা হাটতে লাগল সে।এত রাতে গাড়ি পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার।আজ রাতটা যেন খুবই ভয়ংকর লাগছে।রাফসান ভয় পায়না কখনো।কিন্তু রাতের প্রকৃতিটা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ফোন বের টর্চলাইট জ্বালিয়ে পথ চলতে লাগল রাফসান।বাজে একটা শব্দ আসছে তার কানে।এমন অদ্ভুত আওয়াজ ও কখনো শেনেনি,কি জানি কিসের আওয়াজ এটা।শব্দটা যেন আস্তে আস্তে তীব্র হয়ে উঠছিল।সে ধরতে পারছিল না কেথা থেকে শব্দটা আসছে।এমন বিদঘুটে রাতে,লোমহর্ষক শব্দ তার মনে ভীতি সৃষ্টি করে চলছে ক্রম নিয়ত। মনের ভুল ভেবে ফোন হাতে টিপতে শুরু করল।কথা বলার মতে কেউ একটিভ নেই,তাই নিউজফিডেই ঘুরুঘুরি করল কিছুক্ষণ। ঘড়িতে তাকাতেই লক্ষ্য করল রাত ১ টা বাজে।আর কেনো গাড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।মনের ভয়টা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে লাগল।রাস্তা একেবারে ফাঁকা, শুনশান।মানুষ তো দূরে থাক,কোনো প্রাণীরও দেখা মিলল না।থকবেই বা কি করে,এত রাতে রাস্তায় মানুষ থাকে নাকি!পথ আরও অনেকটা বাকি। এসব ভাবছে,ফোন টিপছে আর রাস্তা চলছে রাফসান।হঠাৎ ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল।কিন্তু ওর ঠিকই মনে আছে,ফোনে চার্জ ফুল ছিল।ফোনটাও ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল!সে একাকীত্ব অনুভব করল।চলার মতো কেনো আলো আর রইল না।কি এক বিপদ,অন্ধকারে এখন ও পথ চলবে কিভাবে? কি আর করা,অন্ধকারে চলার জন্যই পা বাড়াল।হঠাৎ তার পায়ের কাছে কি একটা অনুভব করল।কি এটা,তা বুঝে ওঠার আগেই চাদের সামনে থেকে মেঘ সরে গেল।পূর্ণিমার আলোতে চারপাশ আলেকিত হতে শুরু করল।একটু আগেই যেখানে ছিল তীব্র অন্ধকার সেখানে এত আলো,ও বুঝে উঠতে পারল না।রাতের প্রকৃতি তার সজীবতা ফিরে পেল।রাফসান সেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেল একটা ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে তার পায়ের কাছে পড়ে আছে।এটা কি মানুষ নাকি অন্য কিছু! চাদের আলোয় মেয়েটিকে কোনো রুপরাজ্যের পরীর মতো মনে হচ্ছে।মেয়েটি কি মৃত?সে কি চলে যাবে?প্রশ্ন করল নিজের কাছে।সঠিক কোনো উত্তর পেল না।কিন্তু যদি মেয়েটি জীবিত হয়!তাকে এভাবে রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে?না,এভাবে একটা মেয়েকে ফেলে রেখে যাওয়া কাপুরুষের পরিচয়।ওকে এভাবে রেখে যাওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না।রাফসান মেয়েটিকে স্পর্শ করল।মেয়েটির স্পর্শে অদ্ভুত এক অনুভূতি পেল রাফসান।হয়ত মেয়েরা এমনই হয়!সে অনুভব করল মেয়েটির হৃদস্পন্দন চলছে!সে তার ব্যাগ থেকে পানিভর্তি বোতল নিয়ে ছিটিয়ে দিল মেয়েটির মুখে।হঠাৎ মেয়েটি চোখ খুলল,আর রাফসানের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল।রাফসান বলল,
_অদ্ভুত মেয়ে তো।হাসে কেন ও?এমন সময় কেউ হাসে নাকি আাবার!
হাসির কোনো কারণ না পেয়ে ব্যাপারটা তার কাছে অদ্ভুত লাগল।কিন্তু যখনি রাফসান তার দিকে নজর দিল সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিল না।একটা মানুষ এত সুন্দর কি করে হতে পারে!এত সুন্দর হাসি,চোখ মুখে এত মায়া রাফসান আগে কখনো দেখেনি।প্রেমে পড়ে গেল মেয়েটির,যদিও সে জানে না কে সেই মেয়েটি,কিই বা তার পরিচয়,কি বা তার জাত,কি বা তার ধর্ম। ভালোবাসা হয়ত এমনই হয়! মেয়েটি উঠে বসল।রাফসান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে।মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে জিগ্যেস করল,
_কে আপনি?
_আমি রাফসান।আপনি?
_আমি......আমি.......
মেয়েটা পরিচয় দিতে পারল না।কি যেন বলছিল নিজে নিজে।
_হুম,বলুন।কে আপনি?আর এত রাতে এখানেই বা কি করছেন?কি হয়েছে আপনার?
_জানি না,কে আমি?আমি এখানে কেন?
. রাফসানের বুঝার বাকি রইল না,মেয়েটির মাথার সমস্যা।সে তাকে নিয়ে উঠে দাড়াল।এত রাতে এমন পরিচয়হীন একটা মেয়েকে নিয়ে কি করবে বুঝতে পারল না।বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি পরিচয় দিবে ওর?কি জবাব দিবে তার বাবা মা কে??এখন এতকিছু ভাবার সময় না,বাড়িতে গিয়ে দেখা যাবে।বাবা মাকে বুঝিয়ে বললে অবশ্যই বুঝবে।কিন্তু কিছুতেই তাকে এখানে এভাবে একা ফেলে রেখে যাওয়া চলবে না।
দুজন রওনা দিল বাড়ির দিকে।ভরা পূর্নিমায় দুজন হাটছে।রাফসানের সাথে এত সুন্দরী একটা মেয়ে হাঁটছে! কেমন কেমন লাগছে তার।রাফসান অনেক চেষ্টার পরও তার পরিচয় নিতে পারল না।দুজনে রাতের মতই নিস্তব্ধ, পথ চলছে।কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলে না।রাফসানের খুব ইচ্ছে হল মেয়েটির সুকন্ঠে কিছু কথা শুনতে।কিন্তু কিভাবে বলবে,মেয়েটি তো কোনো কথাই বলে না রাফসানের সাথে।বড়জোর জানিনা,এমনি আর কোনো কথা নেই।চাঁদের আলোয় মেয়েটিকে আরও মায়াবতী মনে হচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটির হাত ধরতে,হাত ধরে কিছুপথ হাঁটতে। কিন্তু ও যেন কেনো এক বাধনে আটকে আছে,কিছুই করতে পারছে না।চারপাশে অনেক ফুল ফুটে আছে,জোনাকীরা দলবেঁধে নৃত্য করছে।দূর থেকে পাখির ডাক শুনা যাচ্ছে। সবাই যেন তাদের বরণ করে নেয়ার আনন্দে মেতে আছে।পাখির গান কোথা থেকে এল এই রাতে?রাফসান এতকিছু ভাবছে না।সে রাতটাকে উপভোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে মেয়েটাকে আরও সুন্দর লাগছে।রাফসান চোখ ই ফিরাতে পারছে না।
হঠাৎ রাফসান লক্ষ করল মেয়েটির কপালে নীল রঙের একটি টিপ!এই টিপ তো আগে ছিল না।যাই হোক,নীল টিপে মেয়েটিকে আরও মায়াবতী মনে হচ্ছে।যেই ছেলে কোনো মেয়ের দিকে অকারণে তাকায়নি,কখনো সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে চায়নি,আজ সে অচেনা অজানা এক মেয়ের জন্য!ভাবতেই কেমন লাগছে তার।রাফসান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠল,
_কি দেখছেন এভাবে?
_তোমাকে.......... না, মানে, [মেয়েটি অনেক্ক্ষণ কর কথা বলল,আর কিছু একটা বলতে হবে]
_কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে পার?
_হুম,বলুন।
_আপনি টিপ কোথা থেকে পেলেন?
_ঠিক ই তো,কেথা থেকে এল এটা?
_আজব তো!
রাফসানের কাছে সবকিছু রহস্য মনে হচ্ছে। এভাবে তাকে পাওয়া,পাখির গান।পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল ফোন খোলা!এখন এত ভাবার সময় নেই। ঘড়িতে প্রায় চারটা বাজে।তার কাছে সবকিছুই রুপরাজ্যের গল্পের মতো লাগছে।মেয়েটির মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু যেন ভুলে যাচ্ছে রাফসান।মনে হচ্ছে রাফসান রুপরাজ্যের রাজা আর মেয়েটি সেই।রাজ্যের রানী।হঠাৎ মেয়েটি পায়ে আঘাত পেল।পড়ে যাওয়ার আগেই রাফসান তাকে ধরে ফেলল।মেয়েটির নিশ্বাসে এক অদ্ভুত অনুভূতি পেল রাফসান।রাফসানের মনে বাজল ব্যাপারটা,কাজটা ঠিক হচ্ছে না।রাফসান তাকে ছেড়ে দিল।মেয়েটি মাটিতে পড়ে গেল।রাফসান আর তুলল না।মেয়েটি নিজেই উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি ধমকের সুরে রাফসানকে বলল,
_আপনি আমাকে ফেলে দিলেন কেন?
_আমি আপনাকে ধরব কেন?
_ধরতেই যখন পারবেন না,তাহলে ধরতে গেলেন কেন?
রাফসান এতে অনেকটাই লজ্জা পেল।সে আর বেশি কিছু বলল না।সে ভাবতে লাগল,
_মেয়েটি মনে হয় ব্যাথা পেয়েছে। আমার এভাবে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি।কিন্তু একটা মেয়েকে আমি ধরব কেন?
তারা আরও কিছুদূর হাটল।ঐ দূরে রাফসানের বাড়ি দেখা যাচ্ছে।রাফসানের মনে রাজ্যের চিন্তা এসে ভীর জমাল।কি বলবে তার বাবা মা কে?কিভাবে বুঝাবে তাদের?তার প্রতীবেশীদেরই বা কি জবাব দিবে?অথচ মেয়েটিকে হাসিখুসিই লাগছে।কে জানে এমন একটা সময় একটা মানুষ কেমনে হাসে!তার বাড়ির মানুষদের না হয় বুঝাল,তার আশেপাশের মানুষদের কিই বা বলবে?এমন একটা মেয়েকে এত রাতে এভাবে বাড়ি নিয়ে আসলে কেউই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিবে না।কিন্তু যে যাই বলুক,এমন ভাবে স্বার্থপরের মতো মেয়েটাকে তো একা রেখে যাওয়া যাবে না।এতক্ষণে মেয়েটাকে অনেকটাই আাপন মনে হল রাফসানের।রাফসান মেয়েটিকে বলল,
_একটা বুদ্ধি দিতে পারবেন?
_চেষ্টা করতে পারি।কি??
_কিছু মনে করবেন না।এত রাতে অাপনাকে নিয়ে গেলে কি জবাব দিব আমি?
_আপনি আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন?
_আজব, আপনি যাবেন না নাকি?
_হুম, যাব।
রাফসানের এখন খুব রাগ হচ্ছে। মেয়েটির কমনসেন্স যদি থাকত!এত রাতে কই যাবে ও,কই থাকবে?তার নিরাপত্তা দিবে কে?হঠাৎ মেয়েটি হেসে বলল,
_পেয়েছি বুদ্ধি।
_কি?
_আপনি বলবেন, আমি আপনার বউ!
এত চিন্তার মাঝেও রাফসান না হেসে থাকতে পারল না।খুব হাসল সে।তার তো মনেই ছিল না,মেয়েটির মাথায় সমস্যা।রাফসান মেয়েটির দিকে হেসে হেসে বলল,
_আচ্ছা, তাই বলব!এবার চলুন।
রাফসান বাড়িতে পৌছে গেল।কলিংবেল এ চাপ দিতে যাবে,এমন সময় হাজার চিন্তা তাকে গ্রাস করল।কি বলবে সে?তার হাত কাপছে। কাপা কাপা হাতে চাপ দিল কলিংবেল এ।সাথে সাথেই মা দরজা খুলল।হয়ত না ঘুমিয়েই বসে ছিল রাফসানের জন্য!রাফসানকে পেয়েই তার মা বলল,
- কোথায় গিয়েছিলি তুই?খুব বড় হয়ে গেছিস,তাই না?
রাফসান মনে মনে ভাবল,
_মেয়েটির সামনে কি অপমানই করল আমার মা!যাইহোক,মেয়েটিকে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। পিছনে ঘুরে দেখল মেয়েটি নেই।এত রাতে কোথায় যেতে পারে ও।নামটা পর্যন্ত জানে না।রাফসান মা কে বলল,
_আম্মু,মেয়েটা.............
এবার রাফসানের মা রাফসানের গালে জোড়ে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল,
_এত রাত করে কি মেয়ে মেয়ে করছিস?মাথা খেলি নাকি তুই?রাত কয়টা বাজে দেখছিস?
হঠাৎ ফজরের আজান শুনা গেল।রাফসানের নিজের ই বিশ্বাস হচ্ছে না,এত সময় কই কাটাল সে!ঘরে এসে গভীর চিন্তায় ডুব দিল সে।কই চলে গেল অচেনা সেই মেয়েটি!